রেন্ট : জিয়া হক
জোবেদার নাম আসলে জুবাইদা। এই নাম কেউ ডাকতে পারে? হয়ে গেল জোবেদা। সে নিজেও জানে না তার আসল নামটা কী, কতটা সুন্দর।
ছাগলের মুখের ধারে ফ্যানের গামলা বসিয়ে দিয়ে দাবায় উঠে দেখে ছোট ছেলেটা পায়খানা করে তার ওপর বসে আছে। আগুন হয়ে গেল জোবেদার মাথা। কেন যে এই আধবুড়ি বয়সে এসে বাচ্চা নিতে গেল।
চড়চড় করে রাগ ওঠে মদ্দের ওপর। ছানা বিইয়ে সে যেন পাপ করেছে। মদ্দটার হুঁশ আছে? সারাদিন সরকারি খালে ছিপ ফেলে মোবাইলে মমতাজ বেগমের তর্জাগান শুনছে। জোবেদা বুঝতে পারে না গান বাজলে মাছ আসবে কেমন করে? এইটুকু বুদ্ধি কি আল্লাহ এই মরদের মাথায় ঠুসে দেয়নি?
বাচ্চাকে পুকুরে নিয়ে কাপড় কাচার মতো আছড়ে ধুয়ে উঠোনে রোদের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে দাবার পায়খানা পরিষ্কার করে জোবেদা। সে ভাবে, আচিয়া কীভাবে তিন তিনটে বাচ্চা মানুষ করল। একটা নিয়ে তার জান কয়লা হয়ে যাচ্ছে।
উঠোনের রোদে বসে বসে পোকামাকড় ধরে মুখে পোরার চেষ্টা করছে বাচ্চাটা। তাই দেখে জোবেদা আর থাকতে না পেরে দাবার পায়খানার ওপর থেবড়ে বসে পড়ল। সংসার করতে তার আর ভাল লাগে না। জোবেদার ছেলে খয়রাত হোসেন তালি বাজিয়ে হাসছে।
এই সময় জোবেদার মরদ মোবারক বদনা হাতে পোঁটের সামনে এসে দাঁড়ায়। অ্যালুমিনিয়ামের বদনার ভেতর কী যেন খলখল করে ওঠে। মাছ ওঠেনি, কাঁকড়া। বাম হাতে ছিপ, লুঙ্গির ট্যাঁকে মোবাইল গোঁজা।
দুপুর হয়ে গেছে। জোহরের আজান দিচ্ছে আনিস মিঞা। পাড়ার লোকেরা গোসল করতে সব পুকুর ঘাটে ভিড় করছে এক এক করে।
মোবারক বলে, এই জোবে বদনাটা রাখ আর গামছাটা দে, গোসল সেরে আসি।
জোবেদা কোনও কথা বলে না।
মোবারক চেঁচিয়ে ওঠে, রাখনা এটা।
একটাও শব্দ না করে চুপচাপ দাবা থেকে নেমে পুকুর পাড়ের গা ধরে সোজা বড় রাস্তায় ওঠে জোবেদা। উঠোনে তখনও গর্দভের মতো দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে মোবারক। কিছুই বুঝতে পারে না।
—এভাবে গল্প শুরু করতেই পারো, কিন্তু তুমি কি তাই চাও, মানে পল্লির জীবনের গল্পই কেন শোনাতে চাইছ, মানে তোমার কি এই জীবনের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ আছে বা এই জীবন তোমাকে এতটাই স্পর্শ করেছে যে তাদের কথা না বললে তোমার ঘুম আসছে না?
—শহরের গল্প তো অনেকেই শুনিয়েছে, শোনাচ্ছে, শোনাবে কিন্তু এদের কথাগুলো বলার জন্য তো কাউকে দায়িত্ব নিতে হবে, তাই না?
—সেই দায়িত্ব কি তোমার? কে দিয়েছে তোমাকে এই দায়িত্ব? যাদের গল্প তারা নিজেরাই বলবে, যদি তারা বলতে চায়। তুমি কে হে শহরের ঘরকুনো ধেড়ে মদ্দ? ছুটি পেলে হয় পাহাড় নয় ইউরোপ ঘুরে এসে মানুষকে চকমকে ইমারতের পাশে কফি খাওয়ার ছবি দেখিয়ে বেড়াও।
—কিন্তু আমি যেভাবে বলতে পারি ওদের কথা সেভাবে তো ওরা পারবে না। ওদের কি সেই পড়াশোনা আছে, দেখার চোখ আছে? নিজের অবস্থা তো নিজের পক্ষে বুঝে ওঠা কঠিন। বাইরে থেকে কেউ না দেখিয়ে, ধরিয়ে দিলে হয়?
—তোমার পড়াশোনা আছে, কিন্তু অভিজ্ঞতা নেই। তুমি জানো শামুকে পা কেটে গেলে গ্রামের লোক কোন গাছের পাতার রস ঘষে দেয়? এই যে তুমি শিক্ষার বড়াই করছ এখানে বসে, ওগুলো কি শিক্ষা নয় বলে তুমি মনে করো? তুমি কী করতে পারো শেষ পর্যন্ত, গ্রামের মানুষের জীবনের ওপর একটু ফ্রয়েড, ইয়ুং, ফুকো, নিদেন মার্ক্স চাপিয়ে দেবে, এই তো? তোমার 'পড়াশোনা' তো শেষ পর্যন্ত এটুকুই করবে বা বড়জোর বিজ্ঞান দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করবে কত অযৌক্তিক তাদের জীবন, সঙ্গে একটু সিমপ্যাথি, এই তো?
—বাদ দিন, জোবেদার কী হল জানতে মন চায়।
—এরকম হাজার জোবেদা রয়েছে হাজার হাজার গ্রামে। কতজনের গল্প শুনবে? ধরে নাও, এই জোবেদা বাপের বাড়ি চলে গেল ও কিছুদিন পর খয়রাত হোসেন নামে একটা বিপত্নীক ছেলের সঙ্গে জুড়ে গেল। ধরে নাও, খয়রাত রেডিও বাজিয়ে বিড়ি বাঁধে সারাদিন। রাতভোর আসনাই করে। জোবেদা একসময় পোয়াতি হয়ে প্রচুর তেঁতুলগোলা জল খেতে শুরু করে আর যখন-তখন ওয়াক তোলে। কিছুদিন পর তার একটা পোলা হয়। খয়রাত ছেলের নাম রাখতে চায় সলিমুল্লাহ আর জোবেদা চায় অন্য কিছু, অন্য নাম। এই নিয়ে দু'জনের খুব টকঝাল হয়। ধরে নাও, শেষ পর্যন্ত জোবেদা জিতে যায় এই খেলায়। ছেলের নাম রাখা হয় মোবারক। রেডিও বাজিয়ে খয়রাত বিড়ি বাঁধে সারাদিন আর মোবারক পায়খানা করে গায়ে মেখে বসে বসে তালি বাজায়। গোরুর দুধ দুয়ে এসে উঠোন থেকে সেদিকে তাকিয়ে থাকে জোবেদা, তাকিয়েই থাকে। ধরে নাও, মাগুরহাটে এক কাপড়ের দোকানে খয়রাতের সঙ্গে দেখা মোবারকের। কেউ কাউকে চেনে না। দু'জনেই তাদের ছেলের ইদের জামা কিনতে এসেছে। জোবেদা তখন মাগুরহাটেই শিমুইয়ের দোকান থেকে লাচ্চা কিনছিল। কাপড়ের দোকানে এসে দেখে খয়রাত মোবারকের জন্যে একটা ফুটফুটে লাল জামা পছন্দ করেছে আর মোবারক একই রঙের ফুটফুটে জামা বেছেছে খয়রাতের জন্যে।
—এও কি সম্ভব? এবার তো আপনি জীবনের গল্প বলছেন না, আপনার গল্প বলছেন।
—তুমি কি জানো, দুই স্বামী, দুই ছেলে নিয়ে জোবেদা এখন যাদবপুরে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে?
—গ্রামে থাকতে পারল না?
—যতদূর পর্যন্ত গ্রাম ওদের গ্রহণ করতে পেরেছিল করেছে, তারপর পুরো ব্যাপারটা শহরের উপর ছেড়ে দেওয়া ছাড়া গ্রামের আর কোনও উপায় নেই খোকা!
—তাহলে গ্রামের গল্প আর রইল কই? বাকি অর্ধেক তো শহর গিলে ফেলল!
—শোনো, জোবেদার আসল নাম জুবাইদা আর জুবাইদা মানে কোমলতনু, জোবেদারা এসব জানে না। জানার দরকার আছে বলে মনেও করে না। গ্রাম ও শহর একসঙ্গে নিয়ে ছোট দু'কামরার ঘরে সে রয়ে গেছে। তার একজোড়া কেয়ারিং হাত চাই আর একটা মাথা-গোঁজার ঘর। নদীর ধারে নাকি পার্কের গায়ে, সেটা জরুরি বিষয় নয়।
এসব বাদ দাও, তুমি বরং মানুষের গল্প লেখো জিয়া।
এই সময় চা নিয়ে ঘরে ঢুকল রফিকবাবুর মেয়ে তাসনিমা যাকে প্রেম নিবেদন করতে প্রতিদিন আমার আসা ও যে-কোনও একটা আলোচনা পাড়ার ফাঁকে একবার তার মুখ দেখতে পাওয়াই আমার রোজকার রোজগার। কিন্তু তাসনিমা নামের মানে কি তাসনিমা জানে?
—একটা ছোট্ট কৌতুহল রয়েছে।
—বলো।
—যাদবপুরে ঘর ভাড়া পেল জোবেদারা?
—ধরে নাও।
—হ্যাঁ, ধরে নিতে হবে। আমাদের সবকিছু ধরে নিতে হবে।
নমস্কার
জিয়া হক
আরম্ভ পোর্টালে প্রকাশিত
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)