মহল্লার নাম আরশ : জিয়া হক

 গত বছর শীতে কী ঘটেছিল আমার জীবনে, মনে নেই। কার সঙ্গে হাতাহাতি করতে গিয়ে মাড়ি কেটে রক্তক্ষরণ হয়েছিল, মনে নেই। রেস্তোরাঁয় কি আদৌ ঢুঁ মেরেছিলাম বন্ধু জুটিয়ে? মনে নেই। টিকিট কেটেও মহিলা কামরায় ওঠার জন্য ৪০০ টাকা জরিমানা হয়েছিল কিনা মনে নেই। শুধু মনে আছে, তোমার সঙ্গে দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছিল আমার। একবারও তোমার দরজার সামনে দিয়ে হেঁটে যাইনি। তাকাইওনি। 


একদিন সূর্য ডুবে যাচ্ছিল আর পাখিরা মেঘের ভেতর দিয়ে ভাসছিল আর আমার কোথাও ফেরার ছিল না বলে উলু ভর্তি মাঠে একা বসে বসে ট্রেনের যাতায়াত লক্ষ করছিলাম। ঘন্টায় দুটো ট্রেন। ট্রেনের ভেতরে লোক, গায়ে লোক, মাথায় লোক, দুই বগির মাঝখানে লোক। গোটা গ্রাম যেন শেকড় উপড়ে শহরে চলে গিয়েছিল। আমাদের শহর। দূর থেকে দেখতে প্রাসাদের মতো মনে হয়, অন্তরটা ফোঁপরা। 


ভেবেছিলাম, তোমার বাড়ি না গিয়ে এখানে কেন অপরাধীর মতো নিজেকে আড়াল করে ঘাপটি মেরে বসে আছি। ভেবেছিলাম। অন্তত হাতমুখ ধোয়ার লোটাভর্তি জলটুকু তো মিলত। সঙ্গে সেই লাল গামছা। আমি, তুমি, অনেকেই ওই লাল গামছাটার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি, জানো? ভাদ্রে স্থলভাগে হাওয়া ক্ষীণ হয়। ফলে জামা ভিজে উঠছিল ঘামে। কেউ যেন এসে তালপাতার পাখার বাতাস করতে করতে জীবনের মানে ব্যাখ্যা করে শুধোবে, তাহলে তুমি কোন পথটা বেছে নিলে? 


এত হুটোপাটির মধ্যে পথ বেছে নিয়ে পদব্রজে বেরিয়ে পড়া কি সম্ভব, বলো? ছিঁচকাঁদুনে বাচ্চার মতো কখনও বলেছি, আমার সঙ্গে মিলবে এমন একটা পথ আমায় এনে দাও যেখান থেকে পারো? সূর্য অস্ত গেল। যারা পানিফল চাষ করে তারা দূরের দীঘির পাড়ে বসে ধূমপান করতে করতে ফলনের অঙ্ক কষছিল বলে মনে হয়েছিল। হয়ত তা নয়। কে কোথায় কী ভাব ধরে বসে আছে তা জানবার উপায় জানা নেই। আকাশে তারা ফুটল। দিনের দেবতা আর রাতের দেবতারা এখন জায়গা অদলবদল করবে। যখনই তারাভরা আকাশের দিকে নজর গেল তখনই মনে হল, কত পুরু অন্ধকার ছিঁড়ে ওই আলো বসানো জাজিমে পৌঁছালো চোখ! কিন্তু শেষ অব্দি গেল তো সে! এইসব কথা তোমাকে বলতে পারি না পাছে তুমি ভাবুক ভাবো আমায় আর এরপর থেকে সবার সব ভাবনার ভার চাপিয়ে দাও আমার ছোট্ট মাথার ওপরে। আমার অকল্যাণ হোক সেটা তুমি চাও না কিন্তু আমার কিসে কল্যাণ তা তুমি আমাকেই ভেবে দেখতে বলো। খুব রাগ হয়। মনে হয়, আর কখ্খনো যাবো না তোমার দরজায়। মুখ দেখাব না। দেখা হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলে সরু গলি বেয়ে বড় রাস্তায় উঠে ভিড়ের মধ্যে মিশে হারিয়ে যাব। রাত বাড়ছে। 


একদিন নৌকোয় যাচ্ছিলাম। তুমিও পাশেই কোনও এক নৌকোয় ছিলে। ভুতুড়ে এক হাওয়া দিচ্ছিল দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে। নাকি উত্তর-পূর্ব! আমার গা ছমছম করছিল না, শুধু ভাবছিলাম তোমার গা ছমছম করে উঠছে না তো! জলের তোড়ে দুলে দুলে চলল আমাদের দুই নৌকো। তোমার নৌকোর মাঝির গান আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। দরদ ছিল। আমার মাঝি সুরেলা নয়। গানও জানে না। দায়ে পড়ে মাঝি হয়েছে। তারা চোদ্দ পুরুষ চাষী। চাষী মাঠের গান, মাটির গান জানে। মাঝি জানে জলের গান। 'আমায় ডুবাইলি রে, আমায় ভাসাইলি রে, অকুল দরিয়ার বুঝি কুল নাই রে'। এই কথা দরিয়ায় এলেই আমার মনে পড়ে। আর মনে পড়ে তোমার কথা। তুমিই যেন দরিয়া হয়ে আগাপাশতলা বয়ে চলেছো। গা ভেজে, মন ভেজে না, কারণ তোমার যাত্রাপথ অজানা, যেখানে নামি সেখানে অতটুকু পাই, সবটুকু মেলে না। তারপরও তুমি পাশের নৌকোয় ছিলে। 

জিয়া হক