সচরাচরিত : জিয়া হক

 কুতুহলে লক্ষ করি সব। 

জগৎ ফুটিয়া আছে আনাচে কানাচে। 

ফুল রচে মাটির দেবতা। 

পতঙ্গ সম্মান বয়ে নিয়ে যায় পুষ্প-পল্লীতে। 

বুঝিলাম, এ জীবন অন্যায্য নয়। 

হারাবে হারাবে করে থেকে যায় প্রতিষ্ঠা যেখানে। 

মরিতে মরিতে তারা পরিবার রচে। 

গোরস্থানের পাশে শ্মশান, সমাধি তবু বিস্তীর্ণ 

ক্ষেত্র জুড়ে পেকে ওঠে ধান্যজীবন। 

স্নেহময়ী রাত্রির বুকে দিবসের সকরুণ 

মুখ দুগ্ধ পান করে। 

মরিবে মরিবে করে ঔষধ কেনে। 

শ্রোতারাই যেখানে গায়ক 

সেইখানে গান নয়, গায়কী প্রধান। 

বিমান সচল হলে দেখব বিমান—সেবিকা সন্ধ্যার। 

রচিতে রচিতে তারা নষ্ট করে ছবি। 

তবু ছবি। থেকে যায়। 

ময়লা আকাশে। 

র‍্যান্ডম রাহাত

 




সরকারের ভিখিরিপনায় করুণা আসে যে গরিবের ঘামের উপার্জনের অংশ চায়।

 শহরে বারুদের মরশুম। গ্রামে চলো এখন পেয়ারার মরশুম।

আমার নিশ্বাস-প্রশ্বাসে ছেয়ে আছে অনেকটা মনে হচ্ছে আর ওই লোককে পরও মনে হয়।

ওর সঙ্গে দেখার করার ইচ্ছাও অনেক কিন্তু যাতায়াতের খরচও মেটাতে হয় যে।

মুখ খোল, চোখে চোখ রাখ, জবাব তো দে, আমি কতবার লুঠ হয়েছি তার হিসাব তো দে।

তোর শরীরের লেখায় চড়াই-উতরাই রয়েছে, আমি তোকে কীভাবে পড়ব, আমাকে বই তো দে। ফয়সালা যা কিছু হোক, মেনে নিতে হবে। যুদ্ধ হোক, বা প্রেম হোক, ভরপুর হতে হবে।

আর বয়স যাদের পাথর ভাঙতে ভাঙতে কেটে গেছে এখন তো তাদের হাতে কোহিনূর হওয়া উচিত। আমি আমার প্রাণের শত্রুকে প্রাণ বলি আর ভালবাসার এই মাটিকে হিন্দুস্তান বলি।

দেওয়ালের এই যে ঘুলঘুলি তা ষড়যন্ত্রের অংশ কিন্তু একে আমি ঘরের আলোকবর্তিকা বলি।

যা দুনিয়ায় শোনা যায় তাকে বলে নীরবতা আর যা চোখে দেখা যায় তাকে তুফান বলে।

আমার মন থেকে এক এক করে সব কিছু বিদায় নিয়েছে কিন্তু একটা জিনিস বাকি আছে তাকে ইমান বলে।

শুধু ছুরিতে নয়, চোখেও জল চাই।

ও খুদা, শত্রুও আমার বনেদি চাই।

আমি আমার শুকনো চোখ থেকে রক্ত ছিটিয়ে দিয়েছি আর এক সমুদ্র বলে, আমার জল চাই। অন্ধকার চারদিকে সাঁইসাঁই করতে শুরু করেছে।

প্রদীপ হাত তুলে দুয়া করতে শুরু করেছে। নিয়ম শিখিয়েছিলাম যাকে চলার, সেই লোক এখন আমাকে হেনস্থা করছে।


রাহাত ইন্দোরি

মহানগরে কবি : কেদারনাথ সিং

 

 


এই এত বড় শহরে

কোথাও থাকে এক কবি

কুঁয়োয় যেমন কলসি থাকে সেভাবে থাকে

কলসিতে যেমন শব্দ থাকে

যেমন শব্দে থাকে ডানার ঝাপটানি

এত বড় শহরে ও থাকে

আর কখনও কিছু বলে না

 

শুধু মাঝে মাঝে

অকারণে

সে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে

তারপর উঠে পড়ে

বাইরে বেরিয়ে আসে

খুঁজে খুঁজে খড়ি নিয়ে আসে কোথা থেকে

আর সামনের পরিচ্ছন্ন চকচকে দেওয়ালে

লেখে 'ক'

 

এক ছোটো

সাদামাটা 'ক'

উঁচু শহরে বহুক্ষণ ধরে 

তার আওয়াজ শোনা যায়

 

'ক' মানে কী

সেপাইকে এক বুড়ি প্রশ্ন করে

সেপাই প্রশ্ন করে অধ্যাপককে

অধ্যাপক প্রশ্ন করে ক্লাসের

সবচেয়ে চুপচাপ পড়ুয়াকে

'ক' মানে কী

সারা শহর প্রশ্ন করে

 

আর এই এত বড় শহরে

কেউ জানে না যে

ওই যে একজন কবি

প্রতিবার এমনি হাত তোলে

এমনিই ওই পরিচ্ছন্ন চকচকে দেওয়ালে

লেখে 'ক'

আর সবাইকে খুন করে দিয়ে যায়!

 

শুধু এতটুকু সত্যি

বাকি সবটা ধ্বনি'

অলংকার

রসভেদ

দুঃখের বিষয় হল

আমি এর বেশি ওর

সম্বন্ধে আর কিছু জানি না।

 

১৯৮৪


তর্জমা ঃ জিয়া হক 



 

উদ্ভটরস ও গোঁজামিল


 

কুকুরটার মাথায় বুদ্ধি, পেটে বুদ্ধি, পায়ে বুদ্ধি, লেজে বুদ্ধি। সে গেরস্ত জীবনে আছে, আবার শহরের ঝাউঢাকায় চরা খেতে যায়। কচিবেলায় মুখে বল্লম খেয়েছিল। বাম চোখের পাশে দাগটা এখন তার সৌন্দর্য। জম্পেশ যুবতীর চ্যাপ্টা তিলের মতো মানানসই। কুকুরবস্তি তাকে যম ভাবে। ওর নাম লেলো। মনে রাখার মতো নাম—লেলো। 


পতাকাটা পড়েই ছিল ঠোঁঙার মতো আলুথালু। হরদিন তো মানুষের পতাকা লাগে না। তবে, পতাকা যে একটা হেলাফেলা করার মতো ব্যাপার নয়, সেটা নিশ্চয়ই সবাই মানবে। পতাকা আছে, তাই আমরা আছি। কিন্তু কেঁচিয়ে দিলো লেলো। সব ঝক্কিহীন শান্তিভর্তি ব্যাপার কেঁচিয়ে দেওয়ার চওড়া ইতিহাস আছে। পতাকায় ডান পা তুলে ইয়ে করে দিয়ে লেলো তার ইতিহাসকে আরেকবার বাঁচিয়ে দিলেও সে বাঁচিল না। শীর্ষ কুকুর আদালতে তার ফাঁসির রায় ঘোষণা হয়ে গেল। ৭ দিন পর দড়ি। 


লেলোর দল পথে নামল। 'লেলো আমাদের নায়ক, তাঁর নিঃশর্ত মুক্তি চাই'। গান গাইতে গাইতে চলল মিছিল 'লেলো/আকাশেই লেজ মেলো'। লেলোর দলের বলিয়ে কইয়েরা প্রশ্ন তুলল :

এক) পতাকা ওভাবে ফেলে রাখা হল কেন? সেটা কি অন্যায় নয়? 

দুই) পতাকার সংজ্ঞা কী? 

তিন) দেশ কি পতাকার চেয়ে বড় নয়? দেশের নাগরিক কি পতাকার চেয়ে বড় নয়? নাগরিকের জীবন কি পতাকার চেয়ে বড় নয়? জীবনের প্রয়োজনে ইয়ে পতাকার চেয়ে বড় নয়? 


লেলোর খাল খিঁচে নিতে চাওয়া দল মিডিয়া দুর্গ দখল করে দেশ-জাতি-ধর্ম ও পতাকার স্বরূপ নিয়ে বোমার ঢঙে কালীপটকা বাজিয়ে আসর গরম করে তুললো। দাবি উঠলো, মহাজগতের সবচেয়ে বড় ও সুন্দর পতাকা তৈরি করে ওখানেই পুঁতে দিতে হবে। মাপ নিয়ে কোনও গোল বাঁধলো না, নন্দনতাত্ত্বিকদের মধ্যে সৌন্দর্যের যথার্থ সংজ্ঞা নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেলো। দরজি কে হবে, তাই নিয়ে তর্ক দেখা গেল দিকে দিকে। অন্তত সতেরো বছর পতাকা বানানোর জ্ঞানগম্যি আছে এমন কাউকে নিয়োগ করা দরকার কেননা এই সেই পতাকা যা দেশের ইতিহাস নতুন করে লিখবে। 


লেলো চুপচাপ। সে হাজতে বসে ডেগি মুরগির উরু চুষতে চুষতে শুধু বলেছে, ''রাষ্ট্রপতির কাছে যাব।''


এই কথা শুনে রাষ্ট্রপতি বিদেশ সফরে যাওয়ার তারিখ দেখে। রাষ্ট্রপ্রভুর বৌ নায়াগ্রার হাওয়া সেবন করার জন্য তেতে উঠেছেন ইত্যবসরে। তাঁরা কানাডায় একটা পশ্যাধিকার সম্মেলনে যোগ দিতে যাবেন। 


দড়ি হয়ে যাবে লেলোর। তার চেলারা কবিতা পড়ছে যেখানে দুর্বৃত্তের টুঁটি টিপে ধরার কথা লেখা আছে। তার বিরোধীরাও ওই একই কবিতা পড়ে যাচ্ছে। চারদিকে যখন ধুলোর ঝড় বইছে তরতর তিরতির করে তখন শীর্ষ আদালত রায় ফিরিয়ে নিয়ে জানালো, বিশেষ তদন্ত সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, লেলো যাতে প্রাকৃতিক করে দিয়েছিল সেটা এ-দেশের পতাকাই নয়, পাশের শত্রু দেশের। অর্থাৎ পতাকা নয়, মূর্তি হবে। লেলোর। সে জাতীয় বীর। মহাজগতের বৃহত্তম মূর্তি হবে তার। জনমত হল, এত টাকার স্ট্যাচুর মুখে পেল্লাই একটা কাঁটাতারের মতো দাগ মানাবে না, ওটা বরং মসৃণ রাখা হোক। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো অন্য জায়গায়। লেজ অর্ধনমিত না রাখলে অণ্ডকোষ বেরিয়ে পড়ছে। 


জিয়া হক