প্ল্যাটফর্মের ধারে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে দেখলাম অদূরে ছড়ানো আলো। তিরিশ মিনিট ধরে অপেক্ষা করছি। এমনই হয়। আমি জানি, দরকারী ট্রেন প্রেমিকার মতো হয়। এই কথা বলা উচিত হল না। আমি যেন পুরুষের পক্ষ থেকে কিছু ঘোষণা করলাম। ছেলেরা কি অপেক্ষা করায় না কার্যক্ষেত্রে? আমি একজন মেয়েকে জানি যার প্রেমিক সব সময় দেরি করে আসত আর মেলা গল্প শুনিয়ে মেয়েটিকে শান্ত করার চেষ্টা করত। এক বছর চার মাস পরে খবর পেয়েছিলাম, নিয়মানুবর্তীতার গ্রাউন্ডে ছেলেটিকে রিজেক্ট করে মেয়েটি এক আইটি কর্মীকে বিয়ে করে দিল্লিবাসী হয়েছে। আর ছেলেটি? সে এখন নামকরা গল্পলেখক।
ট্রেন দেরি করলেই আমার তাদের কথা মনে পড়ে। এই মনে পড়ার কারণ কী? আমি অনেক ভেবেছি কিন্তু উত্তর খুঁজে পাইনি। তবে কেন জানি না ছেলেটিকে আমি সমর্থন করি। তার প্রতি সহানুভূতিও আমার যথেষ্ট। আমাকে ভুল বুঝবেন না। অপেক্ষা করানো একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। এই পাপ মানুষকে নরকগামী করে। সব সত্যি কথা, তারপরও বলি, ছেলেটির কোনো চালাকি ছিল না, কোনো লুকনো পরিকল্পনাও ছিল না। সাধারণত যা হয়। তারা আরেকটু ধৈর্য ধরতে পারত, এটুকুই বলতে পারি।
ট্রেন একেবারে ফাঁকা। যেন একটা বইয়ের আলমারি যেখানে কোনো বই নেই। লোকাল ট্রেন এত খালি কখনো হয় না, যাত্রী মাত্রই জানে। কিন্তু আমি এই ট্রেনে উঠব না। এমনটা মাঝে মাঝে হয়ে থাকে। কিছুর জন্যে অপেক্ষা করতে করতে তার প্রতি আগ্রহটাই মাটি হয়ে যায়। এই কারণে আমার তবলা শেখা হয়নি। এক বছর ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যখন আমাকে তবলা কিনে দেওয়া হল, ততদিনে আমার আগ্রহ ফুরিয়ে গেছে। পড়ে রইল। তবে অনেক পরে বুঝেছিলাম, আমার যখন আগ্রহ ছিল তখন বাবার সামর্থ্য ছিল না। আমরা সব কিছুই বড় দেরিতে বুঝি। এর একটা ইতিবাচক দিক আছে —সব বুঝে গেলে জীবন আর জীবন থাকে না, আমরা বিস্মিত হতে ভুলে যাব, কল্পনায় আর কোথাও যেতে চাইব না। এ বড় আত্মঘাতী ব্যাপার।
ট্রেন চলে গেল। রাত এখন দশটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এমনই এক রাত দশটায় আমাকে সদরপাড়ার গোরস্থানে নিয়ে যাবে বলেছিল মতিকাকু। গোরস্থানে কী এমন দেখবার আছে? শয়ে শয়ে মৃত লোক, জীবদ্দশায় কেউ ছিল কবি, কেউ কাপুরুষ, কেউ মৌলানা, কেউ পরশ্রীকাতর, কেউ দালাল, কেউ সঙ, শুয়ে আছে, মাটির উঁচু উঁচু ঢিবি তাদের উপরে, লতানে গাছের শিকলে বাঁধা স্তব্ধতা চারদিকে। কী আর দেখবার আছে এখানে? সত্যি, সমাধিক্ষেত্রে দেখবার মতো কিছু নেই, তবে এখানে কখনোসখনো নিজের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে।
আমি তখন ছোট। এই এতটুকু। এ সব বুঝি না। এখনও যে বুঝি তা নয়, তবে ছোটবেলার মন আকাশপাতাল ভাবলেও সেই আকাশ ও পাতালের ছোট এক কোণায় সে আশ্রয় নেয় এবং তাকেই সম্পূর্ণ জ্ঞান করে। মতিকাকু কখনো গোরস্থানে নিয়ে যায়নি। রাত দশটার আগেই সে কোথায় পালিয়ে যেত। কয়েক মাস ঘোরানোর পর একদিন মতিকাকু বলল যে সে গোরস্থানে যেতে ভয় পায়। আমি বললাম, কেন?
মতিকাকু বলল, আমি পাপী মানুষ, মৃত্যুকে ভয় পাই আর গোরস্থানে পর পর লাইন দিয়ে মৃত্যু সাজানো আছে, আমি পারব না রে।
মতিকাকুর দোষ ছিল না। আমারও দোষ ছিল না। দোষটা হল, একজন প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসে আর একজন সেই প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাস করে বসে থাকে। তাহলে আমরা প্রতিশ্রুতি দিই বা কেন? মতিকাকু বলেছিল, আমরা প্রতিশ্রুতি দিতে ভালবাসি। আমি এর কোনো বিশ্বস্ত ব্যাখ্যা পাইনি।
বাড়ি ফেরার অনেক পথ। পথ অনেক হলে কোনো পথেই যেতে ইচ্ছে জাগে না। কিন্তু রাত বাড়ছে, বাসেই ফিরব মনস্থির করলাম। মাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি এগারোটার মধ্যে বাড়ি ঢুকব। রোজ বারোটা বেজে যায় বলে বাড়িতে অশান্তি হয়েছে। যুবকদের তো একটু রাত হয়ে যাবেই —বাড়ি বোঝে না। সন্ধ্যারাত্তিরে বাড়ি ফেরা আমার কাছে অশোভন ঠেকে। যারা সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আসেন তাদের প্রতি আমার পূর্ণ সহানুভূতি আছে, শ্রদ্ধা আছে, তাদের এই উদ্যোগকে আমি শর্তহীনভাবে সাধুবাদ জানাই। এ নিয়মটা একেবারে আমার নিয়ম। আপনারা প্ররোচনায় মাথা দেবেন না। পরিবারের প্রতি আপনাদের দায়বদ্ধতা আমাকে সলাজ মুগ্ধ করে। সান্ধ্যকালীন ট্রেনবাসের কাছে অনেক কিছু শেখার আছে।
বাসগুলো একেক করে চলে গেল, আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। রাত আর ঘড়ির মধ্যে কোনও প্রতিযোগিতা নেই। তারা হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলেছে। রাত সাড়ে দশটা।
অটোর অপেক্ষায় দাঁড়ালাম। এটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য হবে জানি না, তবে আজ আমার অপেক্ষা করতে ভীষণ ভালো লাগছে। এরকম হয় নাকি? যুক্তির প্রতি আনুগত্য আমাদের শিখিয়েছে যারা খেয়াল ও খুশি মতো জীবনযাপন করে তারা ঠিক স্বাভাবিক নয়। অস্বাভাবিক হতে সকলেরই ভয় লাগে। তাছাড়া, সবারই কিছু না কিছু কন্ডিশন থাকে। একটা রোগ আছে, যে রোগে আক্রান্ত লোক দুঃখ হলে, রাগ হলে, যন্ত্রণা পেলে কেবল হাসে। বেদম সে হাসি। যারা জানে না এই রোগ সম্বন্ধে তারা কী ভাববে? লোকটা বদ্ধ পাগল। সে কিন্তু পথ চিনে বাড়ি ফিরতে পারে। বদ্ধ পাগলেরা পথ চিনে বাড়ি ফিরতে পারে না। তারা হারিয়ে যায় মহাশূন্যে।
কিন্তু মেয়েটি ফিরে এসেছে। দিল্লি থেকে। আইটি কর্মীকে ছেড়ে কলকাতায় সেই লেট লতিফ গল্পকারের কাছে। চার বছরের ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে। ছেলেটি জোনাকি রঙের টি-শার্ট পরে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এত জানা গন্ধ কেন ওর গায়ে?
'তুমি কি কখনও ইনস্ট্রুমেন্ট বাজানোর কথা ভেবেছ? মানে কাউকে বাজাতে দেখে তোমার কি মনে হয়েছে —আমিও চাই এমন করে বাজাতে। তোমাদের বয়সী ছেলেমেয়েরা গিটার পেলে আর কিছু চায় না।' বলতে থাকে গল্পকার।
ছোট ছেলেটি বুঝতে পারে না কী বলবে। তাছাড়া, একজন অপরিচিত লোক তার সঙ্গে এইভাবে কথা বলছেই বা কেন। চার বছর বয়সের ছেলেমেয়েরা আর কী ভাবতে পারে বলে মনে হয়?
সে একবার তার মায়ের মুখের দিকে তাকায়, একবার এই লোকটার দিকে। মায়ের মুখ দেখে সে বুঝেছে যে তার মা চায় সে একটা উত্তর দিক।
ছোট ছেলেটি আড়ষ্ট ভাবে বলে, আমার তবলা ভালো লাগে।
এই রকমভাবে অনেক কিছু মিলে যায়, এর ব্যাখ্যা হয় না। একে কি সত্যি যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব? আমাদের এতদিনের সাধনার গণিত, বিজ্ঞান কী অসহায় এসবের কাছে। তবলাই কেন বলল ওই ছেলে? হয়ত পুরোটাই কাকতালীয় ঘটনা। হ্যাঁ, তাই-ই হবে। সর্বত্র মিল খুঁজে বেড়ানো কাজের কথা নয় ; হতাশই করে ; এর কোনো মানে হয় না।
গল্পকার সেই ছোট্ট ছেলেকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে তাকে তবলা কিনে দেবে আর একদিন গোরস্থান দেখাতে নিয়ে যাবে। ছোট ছেলেটি জানতে চায়, গোরস্থানে কেন? সেখানে তো ভয় থাকে।
সে তার সদ্যপ্রাপ্ত সন্তানকে বলেছে, গোরস্থানে প্রচুর জোনাকিও থাকে, বাবা।
গল্পকার এখন ট্রেন, বাস ছেড়ে দিয়ে অটোর জন্যে দাঁড়িয়ে আছে। তার এখন তাড়া নেই। তার কখনোই তাড়া ছিল না।
জিয়া হক