দাও ও ২০১৯


আমাকে দাও সেই ভাষা যে-ভাষা নতুন, সেই ভাব যে-ভাব নতুন, সেই কল্পনা যে-কল্পনা নতুন।
আমাকে দাও। আমি লিখতে চাই। আমার মনুষ্যধর্মের পাশাপাশি এই এক ধর্ম আমি বয়ে নিয়ে যেতে চাই। আমাকে মূর্খের দেশে পাঠিও না। আমাকে অজ্ঞের দেশে পাঠিও না। নির্বিকার করো না আমাকে। শুধু দুশ্চিন্তা আমাকে কেন ভোগ করে যাবে? আমাকে আমার উপর জয়ী করো। আমার যা নাকি সম্ভবনা, দিয়েছো, তাকে অনন্ত অন্ধকারের মধ্যে জাগিয়ে রেখো। আমাকেও জাগিয়ে রেখো। অনেক ঘুমিয়েছি। এবার ভারসাম্য দাও। এবার আমার টেবিলে আলো জ্বেলে দাও। এবার আমার কলমে আলো ঢেলে দাও। আমার খাতায় ফুটিয়ে তোলো বিকল্প ফুল। এই ফুলে সুগন্ধ ভরে দাও, এত গন্ধ যে সমুদ্র সুবাসিত হয়। আমাদের বড় দুঃখ, আমি সেই দুঃখ মুছিয়ে দেবার একখানি রুমাল ধার চেয়ে নিতে চাই। এই শীতে আমি যেখানে যেখানে বরফ জমে আছে সেখানে সেখানে আগুন জ্বেলে দিতে চাই। তুমি সে বন্দোবস্ত করো। অকাতরে অতর্কিতে ঘুমিয়ে পড়া লোকের মাথার নীচে বালিশের উচ্চতা দিতে চাই। তুমি সে ব্যবস্থা করো।
আমি তো বামন। চাঁদে হাত দিতে নয়, কেবলই চাঁদের শোভার সুখ্যাত বর্ণনাকারী হওয়ার সু-ভাগ্য দাও। সূর্যে জ্বালানি দেওয়ার আমি কেউ নেই, শুধু উত্তাপ পরিবহনের সু-ভাগ্যটুকু দাও।
দাও।

জিয়া হক 

পাঠিকা ও লেখার অপমৃত্যু সংক্রান্ত


এ লেখা হারিয়ে যায়, এ লেখা বস্তাবন্দি পথ
হারায় রৌদ্রে আর হারায় অন্ধকার জলে
কে আর পৃষ্ঠপোষণা দেয়, এ লেখার পিতামাতা নেই
জন্ম হয় কুমারীর গর্ভ ফোটা ফুল
জন্ম হয় শূকরের শুভ আস্তাকুড়ে
শুভ কেন—এ চিন্তা চিরে দেয় সমুদ্রের রাশি
ভোর হয় চিন্তা নিয়ে, সন্ধ্যা আসে চিন্তারাজ্য থেকে
শূকরেরও দিন ছিল কোনো এক স্বচ্ছ প্রদেশে
সুগন্ধ কোনদিন ছিল না এখানে তাই মৃতেরা আতর ভালোবাসে
এ লেখা হারিয়ে যায়, এ লেখা হারিয়ে যাবে
গোত্রপরিচয়হীন কোনো লবণাক্ত ঘাসে

সজনী পড়বে বলে লিখে রাখি আত্মজীবকথা
প্রেমিকার সৌধ গড়া যেই মতে প্রথা
সৌধ থেকে বালি খসে পড়ে
যেরকম আত্মা হয় রাতের বাগান
পরীরা রাজ্যজুড়ে মানুষের স্নানে
যোগ দেয়
দেশ গড়া হয় এইভাবে
খানিকটা আত্মরতি, খানিক স্বভাবে

এ লেখার মানে কি, এ লেখা কেন লেখা হবে?
মনেতে মাধুরী থাকে, বেকার কর্মীর কোনো স্তবে
উচ্চারিত হবে এ লেখা?
কর্মপ্রার্থী ও কবির কি কোনদিন দেখা—
হয়ে যাবে পথে, ট্রেনে, বাসে?
হয়ত এখানে নয়, হয়ত বাগানে নয়
হয়ত নরম দোকানে কিংবা শ্রীহীন আকাশে।

সূর্য থেকে ঢেউ এসে স্পর্শ করে ঘর
পাঠোদ্ধার হবে হয়ত
                         এই লেখা শীতে অতঃপর।
বসেছে দুজন পাত্রী, মুখোমুখি, রাখা
পদের পাত্রখানি চায়ের পেয়ালা দিয়ে ঢাকা

রচনা উপচে যায়, রচনা তলিয়ে যায় ঘুমে
যে রচে সেও কি মরে না নিজভূমে?
নিজভূমি নীচুভূমি হাজির হয় না সেখানে রোদ
শূন্য পাত্রে বেজে ওঠে অসিদ্ধ ভাতের সরোদ
কে শুনবে সে-গান? ওই গান?
পাখিরাজি, বৃক্ষকুল, যন্ত্রচালিত জলযান।


জিয়া হক 

রাধা থেকে ধারা-পতনের গন্ধ


ভালো আর বাসবে না কেউ, কোথাও আর ধ্রুবতারা নেই
মাঠের মাথায় জাগে বন্য সেই চাঁদ
যা কিছু যায় না ধোয়া তাই আজ জলের তলায়
ধ্রুবতারা চাও কেন? তুমিই যখন নীল গ্রহ
চাওয়া ধর্ম —এই জেনে তুমি রোজ প্রার্থনায় বসো
আলোকিত গাছ থেকে আলোকসদৃশ ফল ঝরে
তুমি তার পাশে এসে, তুমি তার লাবণ্য হতে চাও?

হও তবে, কোথাও রয়েছে কোনো বাধা?
তুমিই কৃষ্ণ জেনো,
                    তুমিই তার প্রকাণ্ড রাধা

জিয়া হক 

মিথ্যুকের গান


ও আমার ঘুমপাড়ানি রাত —বলো
বালিশ বিছানা টলমলো
শয্যাদ্রব্য পানীয় নেয় নাকি?
স্থির নয়, বাকি
বাকি আছে রাতের আঘাত
তপশিলি কোনো উপজাত
ভিক্ষা দেয় যদি
ক্ষতি হবে? হয়ে যাবে বড় লস-ক্ষতি?
নেই বলে হাত পাতে যারা
লোকেরা কি জেনে যায় তাহাদের মুখের চেহারা?
সাধু থেকে শুরু করা লোকে
অমূলক খাদ্যাভাবে ভোগে
অদ্য রজনী তার ঘুম
কেড়ে নেবে গাজনের লৌকিক মরসুম
পরিজন থাকে যদি দূরে
সাংবাদিকের মতো
           জেনে নেয়
আখ্যানের বাকি নাকিসুরে
কে-ই বা আর হায়
শান্তি-পেয়ালা দিতে চায়
                          এই দেশে

জিয়া হক

প্রাচ্যবিদ্যা


ভূত, ভূত, ভূত!
কোথায়?
ওই তো খাটের তলায়।
কই, খাটের তলায় তো কিছু নেই?
না না, দরজার ওপাশে।
দরজার পাশে তো মাদুর দাঁড়িয়ে।
ওই তো, আলমিরার পিছনে।
আরে, আলমিরার পেছনও তো ফাঁকা, কেউ নেই।
তাহলে জানালা দিয়ে পালিয়েছে।
তুই কি মস্করা করছিস? এই এলো আর এই জানালা দিয়ে পালিয়ে গেল? এতগুলো লোক তাকে দেখবার জন্য অপেক্ষা করছে আর সে ব্যাটা পিঠ টান মারল?
ভূত কি আর আমার কথা শুনে চলে নাকি?
কিন্তু তুই তো বললি এখানেই সে আছে।
ভূত এক জায়গায় বেশি ক্ষণ স্থির থাকতে পারে না।
তুই কি ভূতের স্পোক পার্সন? সে নিজে এসেই বলুক না সে কী পারে আর কী পারে না। আমরা কি তাকে অসম্মান করি?
এখানেই তো সমস্যা?
এতে আবার কী সমস্যা?
ভূতেরা আমাদের কাছে সম্মান চায় না, তারা আমাদের কাছে ভয় চায়।
আমরা না হয় ভয়ও করব, সে যদি একান্ত চায়। আমরা কি এতটাই নিষ্ঠুর?
আবার ভুল করলে।
আবার কী ভুল করলাম?
নিষ্ঠুর হবে ভূতেরা, আমাদের হতে হবে মিনমিনে, ভীতুর ডিম।
মিনমিনে মানে কী বলতে চাইছিস? বড় বাবু যেমন তার বৌয়ের সামনে করেন, সেই রকম মিনমিন?
মিনমিনে মানে উঠতে বসতে ভয় পাওয়া, গলা শুকিয়ে যাওয়া, হাত পা কাঁপা, ফিট হয়ে যাওয়া, চোখ কপালে তুলে মেঝেতে শুয়ে পড়া—এই সব আর কি।
এ কী বললি তুই?
কেন?
যাকে দেখলামই না তাকে না দেখেই চোখ কপালে উঠবে কী করে? এ অন্যায় দাবী নয়?
এখানেই তো আসল মজা। সে তো সবাইকে দেখা দেবে না। ভগবান কি সবাই কে দেখা দেয়?
ভূত আর ভগবানকে এক করলি?
এই জন্য তোমরা তাকে দেখতে পাওনা। যা ভূত তাই ভগবান। এই সত্যিটা বুঝতে হবে।
ভগবানের পুজো করা হয়, ভূতের কেউ পুজো করে?
আজ সে এসে এই কারণে চলে গেল। তাকে শুধু ভয় করলে হবে না, ভক্তিও করতে হবে। তোমাদের তার প্রতি কোনো ভক্তি নেই। তাই তোমাদের ভূত-লাভ হল না।
তোর কি ভূতের প্রতি ভক্তি আছে?
ওরে বাবা, বলে কী! ভূতের সঙ্গে আমার অন্য চুক্তি।
চুক্তি?
সে তোমরা বুঝবে না। ভূতেরা সবার সঙ্গে চুক্তি করবে না।
তোর সঙ্গে তার চুক্তি হল কীভাবে?
আরে আমি তো ভূতের ফ্যাঞ্চাইজি নিয়েছি।
ভূতের ফ্যাঞ্চাইজি?
হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগছে তো?
না মানে, হ্যাঁ। কিন্তু ভূতের ফ্যাঞ্চাইজি নিয়ে তুই করবি কী?
আমার কাজ হল ভূতকে প্রমোট করা।
ভূতের আবার প্রমোশন লাগে?
লাগে বৈকি। কার প্রমোশন লাগে না বলো তো?
কিন্তু তাতে তাদের লাভ কী?
যে কোনো প্রোডাক্ট বাঁচিয়ে রাখতে গেলে তার প্রমোশন জরুরি। টিভিতে অ্যাড দেখো না?
তোরা টিভিতে ভূতের অ্যাড দেওয়ার কথাও ভাবছিস নাকি?
না, এখন টিভির চেয়ে ইন্টারনেট বেশি কাজের।
আমার কথাটা এখনও তুই বুঝতে পারছিস না। এসব করে ভূতেদের লাভটা কী?
তুমি যদি এসব বুঝতে তাহলে আর কেরানি হয়ে জীবন কাটাতে না।
একটু বুঝিয়ে বল না।
ভয়ের বিজনেস। এর চেয়ে লাভজনক ব্যবসা আর নেই।
কিন্তু ওরা তো আর কোনো দেশ শাসন করছে না। ভয়ের ব্যবসা করে তারা পাবে কী?
এই তো গোল করলে। কে বলেছে তারা দেশ শাসন করে না! আমাদের দেশ যারা শাসন করে তারা অধিকাংশই ভূত। এরা মানুষের মধ্যে এমন ভাবে মিশে থাকে যে সহজে চেনা যায় না কে ভূত আর কে মানুষ।
তুই বলতে চাস আমাদের চারধারে যে সিপাই-সান্ত্রী, মন্ত্রী-পারিষদ তাদের মধ্যে ভূতেরা মিশে আছে? তাদের অনেকেই ভূত?
বলতে চাইছি না, নয়। এটাই বলছি আর এটাই সত্যি।
কিন্তু আমরা বুঝব কী করে? না বুঝতে পারলে বিশ্বাস করব কী করে?
তোমরা যে অবিশ্বাস করো, তাই নিয়ে ভূতেরা খুব মস্করা করে।
কিন্তু তুই বুঝতে পারছিস না, আমরা বিশ্বাস না করলে তাদের অস্তিত্বই যে টিকে থাকে না।
এই একটা অবৈজ্ঞানিক কথা বলে ফেললে তো!
ভূতের আবার বিজ্ঞান?
পূর্ণিমার রাতে তুমি যদি চোখ বন্ধ করে রাখো তাহলে কী চাঁদের অস্তিত্ব শূন্য হয়ে যাবে?
কিন্তু আমরা তো ভূত দেখতেই চাই, চোখ কোথায় বন্ধ করে আছি? তাদের দেখা দিতে সমস্যা কোথায়?
 এই একটা অর্থহীন প্রশ্ন করলে। আচ্ছা, যারা সিনেমার হিরো হিরোইন হয়, তারা আমাদের বাড়ি এসে দেখা করে না কেন? দেখা করলে কি তাদের নিয়ে ক্রেজটা আর থাকবে? কে আর টিকিট কেটে ঘরের লোককে দেখতে যাবে বলো?
কিন্তু তারা তো আর অদৃশ্য নয়, কোথাও না কোথাও তাদের তো আমরা দেখতে পাই।
ভূতেরা কি বলিউডের নায়ক নায়িকাদের মতো আচরণ করবে বলে তোমার মনে হয়? কেন তারা ওদের নকল করবে কেন? ওদের কোনো মৌলিকতা নেই? ওদের ইন্ডিভিজুয়ালিটি নেই? তারা ভূত বলে আমাদের নকলনবিশি করে বেড়াবে নাকি?
সবই তো বূঝলাম কিন্তু তোকে ওরা পেল কী করে?
পেল মানে?
মানে তুই ওদের পেলি কী করে?
সব কিছুকে খুব সহজ মনে করো, না? আমাকে রীতিমতো পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেতে হয়েছে? অনেক ক্যান্ডিডেট ছিল।
পরীক্ষা? অনেক ক্যান্ডিডেট?
ভূতটা আবার এসেছে। ওই তো সে।
কই, কোথায়?
ওই তো, খাটের তলায়।
খাটের তলায়?
না, এখন দরজার পাশে।
কই, দরজার পাশে তো নেই। দরজার পাশে তো মাদুর।
এখন সে আলমিরার পেছনে।
কই?
এই জানালা দিয়ে পালিয়ে গেল। যাহ!


জিয়া হক
চিত্র ঋণ : রেহান ইসলাম রিদা 

নির্জন লোকটা ও তার গোরস্থান


গরমের দিনগুলিতে সে নিজেই বাগানের চারাগাছে জল দেয়। সে এটাকে প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রকাশ হিসেবে ধরে নেয়। এভাবেই সে পৌত্তলিকতাকে ব্যাখ্যা করে। ঘন সবুজ বনই আসলে দেবতার মূর্তি। পরিচর্যাই কার্যত পূজা —উপাসনা। ঘটনা খুবই সামান্য। একদিন তাকে এই বাগানেই মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার নিজের হাতে লেখা একটি কাগজের টুকরোও পাওয়া গেছে। তাতে লেখা — আমি এই মৃত্যুর তদন্ত চাই না। ভাগ্য বিপর্যয়! একে ভাগ্য বিপর্যয় বলা যায় না। মৃত্যু নামের ঘটনাকে মৃত্যুর সঙ্গেই সমাধিস্থ করা হল, এইভাবে বলা যায় একে। সে দেশ-ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখাতে চাইল কিনা বলা মুশকিল। তবে তার গায়ের রং নীল ছিল না আর সে বাজার বলতে বুঝত নোংরা জায়গা যার শুধু দেহ নয়, আত্মাও বিক্রি হয় সুলভ মূল্যে।
তার পরিবার যখন সেই কাগজের টুকরোর ভাষাকে অস্বীকার করে পুলিশ ডাকল তদন্তের জন্য তখন সে ওই বাগানেই শুয়ে শুয়ে বুঝতে পারল পৃথিবীটা কোনোমতেই গণতান্ত্রিক নয়। এখানে উলঙ্গ লোকেরাই উলঙ্গের নগ্নতা নিয়ে চর্চা করে।
সে চুপচাপ শুয়ে রইল যেভাবে সে পরিবারে এতদিন সময় কাটিয়েছে।

জিয়া হক
চিত্র ঋণ : রেহান ইসলাম রিদা 

দার্শনিক : পুরস্কার প্রাপ্ত


মায়ের কথা বলতে গেলেই বাবার কথা আসে। বারান্দায় বসে থাকা আমার বাবা। ঝুঁকে থাকা একজন মানুষ। যেন এইমাত্র পড়ে যাবেন। দড়ির ওপর থেকে নির্দেশ দিচ্ছেন নিজেকে। কেননা তাঁর নির্দেশ আমরা আর কবেই বা মান্য করেছি। অবমাননাই তাঁর প্রাপ্য ছিল আজীবন। অবমাননাকেই তিনি শ্রেয় জ্ঞান করেছিলেন আজীবন। তাঁর জুতোখানি এখনও সাজানো রয়েছে জুতোর র‍্যাকে, যেভাবে রামের পাদুকা ছিল ভরতের আশ্রয়। তার রাজ্যপাটের অভিজ্ঞান।
আমার মায়ের দাবি শূন্য। তিনি শুধু রান্না করে গিয়েছেন রান্নাঘরে। মায়ের সঙ্গে আমাদের সবার তরিতরকারির স্মৃতি। শীতের রোদে বসে পালং শাক থেকে আগাছা বেছে বেছে প্লাস্টিকের চুবড়িতে রাখছেন—এই হল পরিচিত দৃশ্য। তাঁর জঙ্গলি ছাপা শাড়ি শুকোয় একা একা উঠোনের তারে। দোল খায়। আমরা তাঁর মনের খবর রাখিনি।
সেই মা-ই সেদিন বললেন, বাবা, একবার সমুদ্রে নিয়ে যাবি?
অবাকই হয়েছিলাম। মা কখনও বাড়ির বাইরে যেতে চান না সচরাচর। নিজেকে ঘরকুনো বলেই আত্মপ্রসাদ লাভ করেন।
দু মাস হল বাবা নেই। চিরদিনের জন্য নেই। শিশুদের মতো নক্ষত্রের রাতে তাঁকে আকাশে খুঁজব নাকি গাছের অগণিত পাতায় খুঁজব ভাবি। বাবার প্রিয় নিমগাছটা এখনও বাড়ির সামনে শোভা পাচ্ছে।
মা সমুদ্রে যেতে চায়; মা বাড়ির বাইরে বেরবে—এ কি কম কথা।
বাবা-মা দুজনেই বলতেন তোকে বিয়ে দিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ব। যেখানে যেখানে এতদিন কথা দেওয়া ছিল, যাওয়া হয়নি, যাইনি, সেখানে ঘুরে বেড়াব। সংসার থেকে অবসর নেব। পারবি না সংসার বুঝে নিতে?
বাবা বেরিয়ে পড়েছেন ইহকালের মতো। চিরকালের মতো। মা সমুদ্রে যেতে চান।
আমি জিজ্ঞাসা করি, মা, তুমি সমুদ্রে যেতে চাও কেন?
আজীবন চুপ করে থাকতে থাকতে মা চুপ করে থাকাকেই ধর্ম মনে করেন। তাই তিনি উত্তর দেন না। আমাদের বুঝে নিতে হয়। আমরা কবে বুঝতে চেয়েছি অব্যক্তকে?
মা বেশ খানিকক্ষণ নীরব থেকে কথা বললেন, তোর বাবা বলেছিলেন আমাকে সমুদ্রে নিয়ে যাবে। আমি তো সমুদ্র বলতে শুধু বুঝি জল আর জল যার কোনও কূল কিনারা নেই। তোর বাবা বলেছিল, দার্শনিকেরা সমুদ্র ভালোবাসে।
দার্শনিক কী জানো মা?
আমার মায়ের তো লেখাপড়া কম। তিনি লৌকিক জ্ঞানে শিক্ষিতা। জীবনের সব সমস্যা পেরিয়ে আসতে তাঁর কোনো অসুবিধা হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়েই।
মা বললেন, দার্শনিক মানে আমি জানি না তো রে, তবে তোর বাবা বলেছিল যারা শুধু দেখে যায়, কিছু বলে না, শুধু দেখে যায়।
আমাদের কাজের পিসি তখন ঘরে ঝাঁটা দিচ্ছিল। তিনি সব বিষয়ে মন্তব্যে পারদর্শি।
আমি ঘুরিয়ে বলি, আচ্ছা পিসি দার্শনিক মানে জানো?
পিসি তো কিছু বলবেই। পিসি বলল, ফেরিওয়ালা?
আমি বলি, ঠিক বলেছো।
পিসির মুখে প্রসন্ন হাসি। মা জানেন না যে প্রশ্নের উত্তর সেই উত্তর সে জানে—এ কম কথা নয়।
আমার মায়ের দিকে পিসি আড়চোখে তাকিয়ে নিল একবার।
পিসি চলে যেতে মা বললেন, দার্শনিক মানে তোর বাবা ভুলই জানত, না?
মা, শোনো, আমরা সবাই দার্শনিক,--তোমার বিশ্বাস হয় আমার কথা?
তারা সমুদ্র ভালোবাসে কেন? মা জানতে চান।
মাকে কীভাবে বোঝাব যে বাবার যুক্তি অকাট্য নয়। দার্শনিকরা পাহাড়, মরুভূমি, ঝর্ণা, গিরিখাত, হিমবাহ সবই ভালোবাসতে পারে। বাবাকে কি ভুল প্রমাণ করা উচিত হবে। বাবা তো মায়ের কাছে একজন শুধু মানুষ নয়,--বিশ্বাস, স্থান, তীর্থ।
এক সপ্তাহ পরের কথা। আমরা ভাইজাগ-আরাকু উপত্যকা ঘুরে এসেছি। এখানে পাহাড় আছে, পাশাপাশি সমুদ্রও।
দুপুরে বাড়ির বারান্দায় মা গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছেন। আমি পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম মায়ের।
খুব নরম স্বরে বললাম, মা, তোমার কোনটা ভালো লাগল? পাহাড় না সমুদ্র?
মা বললেন, মানুষ।




জিয়া হক

অযথা বিপ্লব ২০১৯


কী হবে এই দীর্ঘদিন, কালো কালো মেঘ
পাখিরা ফুলের কাছে মধু চায় নাকি
কী হবে ও মাছেদের রোদনসঙ্গীত
আমি কি নিরামিষাশী, সমাজ-আহত
নিদ্রাশেষে জলাধারে খাব সামাজিক
কেন যে কোথাও নেই মৃত মানুষেরা
কোথাও কেন যে নেই পূর্বমাতৃদল
সূর্য কি আলো দেয় দুপুরে ও ঘরে?
ঘরেতে ঘুমোয় যারা স্বপ্ন-দার্শনিক
তারা কি পুরনো রীতি কলঙ্কিত করে?


জিয়া হক 

মোজাফফর হোসেন ও তাঁর গল্পচিন্তা


কিছু বই পড়বার ইচ্ছা থাকে, —সহজে মেলে না। আচমকা পেয়ে গেলাম, —এ অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তিই।
এবার আপাতত পাঠ ও পরিক্রমা।
বিস্তারিত ক্রমপ্রকাশ্য... 

উজ্জ্বল ঘৃণাদের ভিড়


এই উজ্জ্বল ঘৃণা আমাকে ফিরিয়ে দাও
দাও ওই ঘৃণ্য উজ্জ্বলতা
সাবেকী রাতের শীতলতা, —প্রীতির পিরিচে
নীল শুদ্ধ চা
সে তো জানে না অজ্ঞতা কী
ভেবে দেখো তাকে ক্ষমা করা যায় কিনা
সে তো জানে না ক্ষমা কী
যে ঘৃণা প্রকৃতই উজ্জ্বল বলে মনে করা হয়
যে মন প্রকৃতই মৃদুমন্দ বয়
কে তাকে প্রেমপ্রস্তাব দেয় বছরের ওইসব দিনে

জিয়া হক 

ঈশ্বরের দরবার


ওদের দাবি অন্যায্য নয়। দাবি আছে মানে কোথাও ক্ষীণ হলেও কোনও যুক্তি পরম্পরা আছে ; অন্তত বিশ্বাস আছে। যে প্রার্থী সে সব সময় প্রার্থনার যোগ্য না হলেও সে যে তার প্রাপ্তির ইচ্ছা প্রসারিত করেছে সেটাই বিবেচনার। এতে কি দুর্বলতা প্রকাশ পায়? স্বাভিমান নিকাশিত হয় কি? হয়ত হয় কিন্তু তা গুরুত্বপূর্ণ নয় তখন। প্রয়োজনই প্রণিধানযোগ্য। কথা অন্যত্র। আমরা তো দাবিদার, আমরা কি অপর দাবিদারদের বিষয়ে সচেতন? যদি না হই, যদি চিন্তায় অযত্ন থাকে তাহলে প্রার্থনা করার অধিকার থাকে না। জ্ঞানদানন্দিনী একবার আমাকে প্রশ্ন করেছিল, তুমি জীবনের কাছে কী প্রত্যাশা করো?
আমি বলেছিলাম, শান্তি।
সে পরক্ষণেই বলেছিল, তুমি কি কারও শান্তির কারণ হয়েছো কখনও?
আমি বলি, না।
তাহলে জীবন তোমাকে শান্তি দেবে কেন? সে সপ্রতিভভাবে জিজ্ঞাসা করে।
তারপরই শান্তির সংজ্ঞা জানতে চায়।
আমি উত্তর দিতে পারিনি সেদিন। আজও পারব না।
হাত পাততে গেলে যেমন হাতের থাকা জরুরি তেমনই হাত পাতার আগে সেই হাতের ইতিহাসে কিছু কার্যক্রম থাকাও বিশেষ জরুরি।
ভিখিরি কি রোজ বাড়ি ফিরে তার ভিক্ষাপাত্র সাবান দিয়ে মাজে? সে কার কাছে কৃতজ্ঞ —ভিক্ষাপাত্র না মানুষের কাছে? কে তাকে বঞ্চিত করে —ভিক্ষাপাত্র না মানুষ?
বৃক্ষরোপনের রচনা লেখার আগে একটা বৃক্ষচারা রোপন করা জরুরি।

জিয়া হক