আমিও চৌকিদার : একটি গল্প


........................
—ইন্টারনেট আমাকে অসুস্থ করে তুলছে। আমি একজন মিলেনিয়াল। দুধে কি কেশর দেওয়া আছে? খেতে খুব সুন্দর হয়েছে। হ্যাঁ, আমি একজন মিলেনিয়াল, ইন্টারনেটের উঠে আসা আর আমাদের বেড়ে ওঠা তো প্রায় একই সময়ে, আলফা প্রজন্ম এসে গেছে, সে যাকগে, কিন্তু মূল কথা হল, ইন্টারনেট আমাকে বড় কষ্ট দিচ্ছে।
—তুমি কি ভীষণভাবে অ্যাডিক্টেড?
—কোকেনের চেয়ে বেশি। ইদানীং তো দিন-রাতের হিসেব গুলিয়ে যায়। সূর্য ডোবা যে কতদিন দেখি না! চোখের বড় অপব্যবহার করছি। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল, সারাদিন ইন্টারনেটে কী যে দেখি তার কোনও সদুত্তর দিতে পারব না। তাহলে আমি কী দেখি? আদৌ কি কিছু দেখছি?
—ইন্টারনেট প্যাকেজ রিচার্জ করা বন্ধ করে দাও তাহলে, এছাড়া আর উপায় কী?
—একবার করে যে দেখিনি তা নয় কিন্তু উইথড্রল সিনড্রোম দেখা দিতে শুরু করে। সে যে কী ভয়ানক ফিলিং!
—কেমন হত?
—সেটা আমি বলে বোঝাতে পারব না, তবে পাগল-পাগল অবস্থা। ড্রাগ নেওয়া বন্ধ করলে যেমনটা হয় আর কি। বিস্কুটের উপর চিনি ছড়ানো দেখে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। আরেকটা দে তো।

আমাদের কথা শুরু হলেই রাত্রি গভীর হয়ে যায়। এটা একটা গভীর ষড়যন্ত্র, বুঝতে পারি, যদিও কুচক্রীদের হাতেনাতে ধরতে পারি না। খেয়াল করে দেখেছি, যখন থেকে আমি তর্ক করা ছেড়ে দিয়েছি, তখন থেকে আমার সঙ্গীসংখ্যা আশ্চর্যজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। একটি লোকগীতি শুনেছিলাম বহুদিন আগে, সেখানে গায়ক বলছেন যে কান, চোখ দুটো করে আছে কিন্তু মুখ মাত্র একটা তাই দেখবে আর শুনবে, কথা কম বলবে। শব্দভান্ডার নিপাত যাক। দাদা দুঃখবোধ নিয়ে বাড়ি চলে গেল।

আমার বন্ধু আফরোজের সঙ্গে এই দাদার কখনও সম্ভব হলে আলাপ করিয়ে দেব। আফরোজ শ্রীনগরে থাকে। ওর সঙ্গে যোগাযোগ নেই প্রায় দু-মাস। কয়েক মাস আগেও আমাদের প্রতি সপ্তাহে কথা হয়েছে। ১১ই জানুয়ারি ওর জন্মদিন। মূল কথা হল, কাশ্মীরে এখন ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ। এ বছর জন্মদিনে ওকে শুভেচ্ছা জানাতে পারিনি। আফরোজ আমার এই দাদাটির মতো খানিকটা—ইন্টারনেট অ্যাডিক্ট। ওর কি এখন উইথড্রল সিনড্রোম দেখা দিয়েছে? আজ আমাদের বাসায় কাটা পোনা রান্না হয়েছে।

এলাকায় চোরের উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় তরুন সংঘ ক্লাবের ছেলেরা রাতে পাহারা দিতে শুরু করেছে। পাড়ার প্রতিটা বাড়ি থেকে একজন করে লোক এই দলে যোগ দেয়। দলটা বেশ বড় হয় কেননা ঘর তো কম নেই। রাত আড়াইটে অবধি এই পাহারা চলে রোজ। বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে প্রতিটি বাড়ির যুবকদের যুদ্ধে যোগ দেওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। আমাদের পাড়ায় এখন যুদ্ধ-পরিস্থিতি। চোরদের সমস্যা হল, তাদের কোনো কৃপাকারী দেবতা বা অপদেবতা নেই। এককালে দস্যুদের কালিকা ছিল, বলিটলি দিয়ে রক্ততিলক কপালে টেনে পল্লীজয়ে বের হতো তারা। দেবী বা দেবতা একজন দরকার, অন্তত আমাদের মতো দেশে। আজ গাছে বিন্দুমাত্র বাতাস নেই।

রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ গিয়ে ভিড়লাম পাহারার দলে। তরুন সংঘ ক্লাব। কয়েকজন গঞ্জিকা সেবন করছে। গাঁজার গন্ধেই একটা নেশা থাকে। খানিকটা দূর থেকে সেই গন্ধ নাকে এসে লাগছে। মাথাটা তাতেই ঝিমঝিম করে উঠল। একটা ছড়া ছোটবেলায় শুনেছিলাম —
আপেলে ধরেছে পোকা
দুধে দেয় জল
গাঁজায় বুদ্ধি বাড়ে
পানে বাড়ে মল।

আমাদের দলটা যখন মন্ডলপাড়া স্কুল পেরিয়ে হাজার ফুট কলের ধারে এসে দাঁড়াল তখন শিবেন্দু বলল, "তপন মাস্টারদের পেঁপে গাছগুলো দারুণ হয়েছে, তাই না?"
শিবেন্দু আমাদের দলের শিক্ষিততম ছেলে। ডবল এম এ আছে, তবে কোন কোন বিষয়ে তা জানি না। তাত্ত্বিক নেতা, সুবক্তা, নানা রকম ম্যানিফেস্টো পড়া ছেলে। চাকরি নেই তাই চাকরি পায়নি। সেই কারণে সুকন্যার সঙ্গে সম্পর্কটা টিকল না। টিউশন পড়িয়ে সে একপ্রকার টিকে রয়েছে।
জগন্নাথ বলল, ওদের পেয়ারা গাছগুলো কি খারাপ? তাকিয়ে দেখ একবার।
দুটো কুকুর আমাদের দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকাতে তাকাতে আজাদনগরের গলির দিকে ঢুকে গেল। ইলেকট্রিক পোস্টের তীব্র আলো রাতকে নিশুতি হতে দিচ্ছে না। অন্ধকারকে আপ্রাণ ঠেকিয়ে রেখেছে।
শিবেন্দু বলল, জগা, তোর কি ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন বিষয়ে কোনো জ্ঞান আছে?
জগন্নাথ বলল, একটু একটু।
শিবেন্দু এবার তাকে প্রশ্ন করল, আচ্ছা বল তো, ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন আসলে লাইফ সায়েন্স না হোম সায়েন্স?
এত গভীর ও সূক্ষ্ম প্রশ্ন জগন্নাথ প্রত্যাশা করেনি। সে মাথা চুলকোতে লাগল। জগন্নাথ খর্বকায়, চুল কোঁকড়ানো, টাইমেক্সের ঘড়ি পরে, পায়ে কোলাপুরি ধরনের চামড়ার জুতো।
গগনদা বয়েসে একটু বড়। সে বলল, তোরা এ সব রাখ। আজ চুরি হতে পারে, আমার কাছে খবর রয়েছে। একটু এই দিকে মন দে, চল—পিন্টুদার দোকানের ওদিকটায় যাই একবার, হকির স্টিক দুটো এনেছিস তো?
শিবেন্দু তখনও তপন মাস্টারদের ফলের গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে। অস্ফুটে সে বলল, পুরো হলুদ হয়ে গেছে, গাছেপাকা জিনিস বাজারে এখন আর পাওয়াই যায় না।

ঘন্টাখানেক টহল দেওয়ার পর আমরা ক্লাবের গুমটি ঘরে ফিরে এলাম। নিপুনভাবে চৌকি দিয়েছি আমরা। পাড়া আমাদের হাতে সম্পূর্ণ নিরাপদ। বেশ সুন্দর, আলোয় আলোয় ভরা। শিবেন্দু, জগন্নাথ, গগনদা আর সবাই ক্লাবের লাল মেঝেতে আলতো করে নামিয়ে রেখেছে ৪টে হলুদ পেঁপে আর গোটা পনেরো পেয়ারা।
গগনদা সিগারেট ধরিয়েছে, কেউ একজন টিভি চালু করল, ছুরি দিয়ে ফল কাটতে বসে গেল দুজন।

না, সে-রাতে আমাদের পাড়ায় কোনো চোর আসেনি।


জিয়া হক




শিক্ষক দিবস


.................. ..................................................... 
নির্মলতা এনে দাও বাসনে, বিদ্যালয়ে, জঞ্জালে ও স্তূপে
শিশুরা রয়েছে, আছে আদি মাতা, গোত্রের সুন্দরী
বিদূষক, কবিরাজ আছে, আছে কীর্তনগায়ক
মাজারের পির আর মৌলানা হুজুর,—আছে
ও আকাশদেবতা, ও জলজ সান্নিধ্যের দেবী ও মায়েরা
দাও নির্মলতা,
আমাদের বর্জন করো যদি বর্জ্যদ্রব্য হয়ে আমরাই কি
জঞ্জাল হব না?
আমরা যেখানে যাই সন্তান প্রসব হতে থাকে
ইস্কুল বানাই, শিক্ষা দিই আমরাই প্রথম আর স্বর্গ আমাদের
যে যত উপহার পায়, সে তত প্রধান শিক্ষক

জিয়া হক 

ব-দ্বীপবাসীর সুসমাচার : জিয়া হক


......................................... ..............................................
দিনকে দরিদ্র মনে হয় কেন? তার তো আছে রাত্রির সম্পদ
তার তো আছে সৌর মৌলিকতা, —
কর্মকাজ, দৃশ্যতই স্পষ্ট কৃষিক্ষেত্রজমি
তবে তার বেদনা কোথায়, কোথায় দুঃখ রপ্তানি?
আমি তো মীমাংসক নই, নই পীর কেবলা হুজুর
বুদ্ধের মতো অথচ বলতেও পারি না, 'আমি তো জানি না'
নীরবতা শেখার নৈশ বিদ্যালয়ে যাইনি কখনও
গুরুরা বশীভূত করতে চায়, চায় মৌখিক বিস্তার
চেয়েছে সব ফুল ফোটে যেন তারই বাগানে,
যদিও পিপীলিকা ঘৃণা করে তারা, পিঁপড়ার অধিকার
ধরো তুমি এই দিন, ধরো তোমাকেই করুণা করে কেউ
চাকুরিরতা, সুবক্তা স্বামী যা কার্যত প্রভু, ডালিম
পাতার মতো শিশুতে সাজানো তোমাদের সোফা ও বিছানা
নাগরিকপঞ্জি সুসমাচার আনে, ধর্মগৃহে যাতায়াত আছে
তবু কেউ যদি দরিদ্র বলে, করুণাই করে, কী করবে তুমি?
ফিরিয়ে কি দিয়ে দেবে পুনরুক্তি করে? পূর্বোক্ত কথা
আত্মীয় মনে করে, এ সবেরই লক্ষ্যবস্তু তারা
তারা কি জানে না পৃষ্ঠপোষনা কুক্কুরও চায়?
পশুদের মন, সর্বোপরি তার মনে হওয়া!


চিত্র : mi wallpaper

ভাস্করকে লেখা চিঠি


প্রিয় ভাস্কর, 
সম্বোধন করার রীতি মেনে 'প্রিয়' লিখতে হল, অথচ তুমি তো জানই এ কত সামান্য নৈকট্য বয়ে আনে। 
আজ রবিবার। 
এখন সকাল উত্তীর্ণ হয়ে যেতে বসেছে আর আমি বসেছি তোমাকে একখানি পত্র লিখিবার খোয়াইশ নিয়ে। 
অনেক ভেবেছি, কেন আর কেউ চিঠি লেখে না কারণে-অকারণে, দুর্দিন-সুদিনে, ভিড়-একাকীত্বে? 
হয়ত বিরক্তিই উৎপাদন করছি, 
এ সকল প্রগলভতা, বাগাড়ম্বর মনে হতে পারে কেননা এখানে কাজের কথা, 'কেজো' কথা নেই, যা আছে তা হল সংযোগাযোগের শ্রীময়ী ইচ্ছা। গতকাল যাদবপুর গিয়েছিলাম।
 মহারাজ এসেছিলেন। 
অনেক কথার পর বুঝলাম, আমরা ভারতাত্মা নিয়ে চিন্তিত, উদ্বিগ্ন, কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
 তোমাকে কেবলই মনে পড়ে গেল। 
যাদের বিবেক কলুষমুক্ত তাদের বিবেচনা শুনতে হয়, যেভাবে তোমার ভাবনা জানতে চাই নানা বিষয়ে, যদিও আমরা কোনও আন্দোলন তৈরি করতে পারি না, তবু আশা জাগে একদিন আমাদের দ্বৈত কথোপকথন ছড়াবে ধান্যশস্যের মতো, সবুজ হবে অনুর্বর শাসকের হৃদয়, মগজ। 

প্রীতি জেনো 
জিয়া হক

চিত্রকলাঃ ভ্যান গখ